Monday, May 1, 2023

বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থান-রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবীদের দায় -শাহজাহান কবীর

 বাংলাদেশে উগ্রবাদের উত্থান -

 রাজনীতি ও বুদ্ধিজীবীদের দায় 

    

   শাহজাহান কবীর 

সুলেখক আনিসুল হক তার একটি নিবন্ধে  যথার্থই লিখেছিলেন  -" "বাংলাদেশের মানুষের পরাজয় নেই কারণ তার সংস্কৃতি আছে। " তিনি এই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করতে পেরেছেন এই কারণেই যে আমাদের সংস্কৃতির চরিত্র বৈশিষ্ট্যটি তিনি জানেন। বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও  সংস্কৃতি কখনোই মৌলবাদ ও উগ্রবাদের জন্য অনুকূল ছিলনা। বাংলার এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস কোন ধর্ম নয় বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শের উপর  ভিত্তি করে মানবতাবাদী ও উদারচিন্তার গভীর থেকে প্রজন্ম পরম্পরায় গড়ে উঠেছিল আমাদের সংস্কৃতি। সেই চর্যাপদের যুগ থেকেই ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক  বিষয়ে সম্প্রীতি, সহাবস্থান ও সহমর্মিতার এক  উদারনৈতিক আদর্শের সড়ক ধরেই  সমৃদ্ধ এক সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করেছে আমাদের এই ভূখন্ডে। বৌদ্ধধর্ম ও শ্রীচৈতন্য দেবের সহজিয়া মতবাদ এবং মুসলিম সুফীবাদ এই তিনটি উদারপন্থী মতবাদের সরল পন্থায় আকৃষ্ট হয়েই বাংলার জনগণ ধর্মীয় উগ্রবাদের বিপরীতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বিকাশকেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছিল।এই সংস্কৃতিতে  আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মীয় ভক্তিবাদ থাকলেও এর প্রাণপ্রবাহের মূলে ছিল ভ্রাতৃত্ববোধ,মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদারচিন্তা।বাঙালি সংস্কৃতির গভীরের দাবীটি সবমসময়ই  ছিল সর্বোপরি আনন্দ এবং সাম্প্রদায়িক  সম্প্রীতির।সম্প্রদায় ভিত্তিক বিশ্বাস বা ধর্মাচরণ কখনোই এই সম্প্রীতির পথে বাধা হিসাবে দাঁড়াতে পারেনি। বাংলাদেশের বাউল সম্প্রদায় মানতাবাদী এই ভাবধারার প্রচার ও প্রসারে বিরাট ভূমিকা রাখেন। সেই সাথে  যাত্রা,জারি সারি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি  মুর্শিদী গান ও আরও নানারকম লোকসংস্কৃতি ও লোকাচারের  মাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতির এই সুন্দর ও সরল চরিত্রটির শেকড় ক্রমশ আমাদের জাতীয়  চেতনার গভীরে বিস্তৃত হয়। বৃটিশ শাসনের একটা পর্যায়ে উনিশ শতকে এসে হিন্দুত্ববাদের জাগরণের একটা প্রচেষ্টা শুরু হয় যার প্রবক্তা ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। একই সময় ওহাবী ও ফরায়েজি আন্দোলনের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মীয় ভাবধারার জাগরণের একটা চেষ্টা করা হয়। তবে এইসব আন্দোলন সমূহে ধর্মীয় বিশ্বাস, ধর্মীয় আচার ভাবধারার প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা থাকলেও অবশেষে এদের আন্দোলন  মূলত বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনেরই রূপ লাভ করে।  সাতচল্লিশের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে হিন্দু মুসলমানের আলাদা ভূখণ্ডের চিন্তার মাধ্যমে  আমাদের সংস্কৃতিতে  ধর্মীয় ভাবধারাকে প্রধান করে তোলার যে চেষ্টা শুরু হয় তার মূল কারণটি ছিল রাজনৈতিক - ধর্মীয় নয়। সাতচল্লিশ পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি  ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক রূপে আবির্ভূত হয়  এবং  রাজনৈতিক স্বার্থে বাংলার  চিরায়ত সংস্কৃতির উপর ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের যে আন্দোলন গড়ে উঠে সেই আন্দোলনে রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা -এই দুটি দাবীই  সমানভাবে প্রবল হয়ে উঠে। একারণেই একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম  সকল সম্প্রদায়ের  মিলিত শক্তির  স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আবেদন ও আবেগ মিশ্রিত হয়ে একটি সর্বাত্বক জনযুদ্ধের রূপ লাভ করে। রাজনীতির সঙ্গে আমাদের জাতীয় সাংস্কৃতির  তীব্র আবেগ  যুক্ত হয়েছিল বলেই আমাদের মুক্তিযুক্ত স্বাধীনতার পথে এতটা দ্রুত পৌঁছাতে পেরেছিল। একাত্তর পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা,ব্যারাক থেকে উঠে আসা সামরিক শাসকদের মাধ্যমে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে যে অস্থিরতা এবং মূল্যবোধের অবক্ষয় সৃষ্টি হয় সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে একাত্তরের পরাজিত  সাম্প্রদায়িক  রাষ্ট্রটি তাদের এদেশীয় এজেন্টদের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিরন্তন উদারপন্থী সংস্কৃতির উপর উগ্রবাদ প্রতিস্থাপন করার একটা তোড়জোড় অপচেষ্টা  চালায়। বাংলাদেশের সামরিক শাসকেরা এই সময়টাতে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে থাকে তাকে এক কথায় বলা চলে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার রাজনীতি। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার এই রাজনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে সামরিক শাসকেরা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের প্রথমে প্রশ্রয় দেয় এবং ক্রমশ তাদের লালন পালনের দায়িত্ব নেয়। রাষ্ট্র ও রাজনীতি অবতীর্ণ হয় ধর্মীয় উগ্রবাদ বিস্তারের  প্রধান সহায়কের ভূমিকায়। যদিও বাংলাদেশের এই ধর্মীয় উগ্রতার রফতানি কারক পাকিস্তানের সহায়তায় আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশসমূহ তবে মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় উগ্রতার সাথে বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রতার একটি বড় ধরনের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মীয় উগ্রতার মর্মে রয়েছে তাদের জাতীয়তাবাদ এবং পশ্চিমা সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের তীব্র বিরোধিতা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের উগ্রবাদের লক্ষ্য  পশ্চিমা আগ্রাসনের বিরোধিতা যেমন নয় তেমন জাতীয়তাবাদও নয় বরং  বাঙালী জাতীয়তাবাদ ও বাংলার চিরন্তন সংস্কৃতির বিরুদ্ধাচারণই বাংলাদেশের ধর্মীয় উগ্রতার লক্ষ্যে পরিনত হয়। সে কারণেই এদেশের  মৌলবাদীদের সব সময়ই বাংলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ধবংস করার উদ্দেশ্যেই তৎপর থাকতে দেখা যায়। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ব্যক্তিগণই তাদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠে। সেনা শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান কতৃক সংবিধান থেকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ অপসারণ করে বাংলাদেশী জাতীয়তাদ সংযোজন, জয়বাংলার বদলে পাকিস্তান জিন্দাবাদের অনুকরণে বাংলাদেশ জিন্দাবাদ স্লোগানের সৃষ্টি, স্বাধীনতার বিরোধীদের ধর্মীয় রাজনীতি করার সুযোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে জেনারেল জিয়া সাম্প্রদায়িক অপশক্তির একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক হিসাবে নিজের অবস্থান পরিস্কার করেন এবং উগ্রবাদীরা দ্বিগুণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে অসাম্প্রদায়িক উদারচিন্তার বাঙালী সংস্কৃতি ধবংস করার কর্মতৎপরতা শক্তিশালী করে তুলতে থাকে। জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম  ঘোষণা দিয়ে বুঝিয়ে দেন যে এদেশ এখন  উগ্রবাদীদের অভয়ারণ্য। এই যখন বাস্তবতা তখন আওয়ামীলীগ তাদের নীতি আদর্শের বিপরীত পন্থা অবলম্বন করে সেই সময়কার সরকার বিরোধী আন্দোলনে জামাতের সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতা স্থাপন  করে এবং জামাতের সঙ্গে একই মঞ্চে সরকার বিরোধী জনসভায় অংশ নেয়।আওয়ামীলীগের এই আদর্শিক বিচ্যুতি  সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে অধিকতর সাহসী  করে তুলে । পরবর্তীতে  খালেদা জিয়ার নেতৃতাধীন বি  এন পি'র রাজনীতির একমাত্র ভিত্তি হয়ে উঠে এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি। বি এন পির শরীক দল হিসাবে স্বাধীনতা বিপক্ষ শক্তি সরাসরি এদেশের ক্ষমতায় অবতীর্ণ হয় এবং মূলত দেশ পরিচালিত হতে থাকে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির নির্দেশে। এমন অবারিত সুযোগে  উগ্রবাদ তার ব্যপক বিস্তার ঘটাবে এটাইতো স্বাভাবিক। হয়েছেও তাই। মমধ্যপ্রাচ্যে এবং এদেশীয় পাকিস্তানপন্থী কোটিপতিদের আর্থিক সহায়তায়  উগ্রবাদ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের সর্বত্র তার শেকড় ছড়িয়ে দেয়। এর ফলশ্রুতিতে দেশব্যাপী শুরু হয় উগ্রতার নৈরাজ্য।  একই দিনে সিরিজ বোমাবাজিসহ,রমনার বটমূল,উদীচির মঞ্চ, সিনেমা হল, যাত্রা ও সার্কাসের প্যান্ডেলে একের পর এক বোমাহামলা চালায় উগ্রবাদীরা। বাউলমেলায় আক্রমণ, বাউলদের ভিঠেছাড়ার করা সহ সর্বত্র  শিল্প ও শিল্পীদের উপর চড়াও হয় তারা।   দেশজুড়ে সংস্কৃতিকর্মীদের মাঝে আতংক ছড়িয়ে দেয় এসব নাশকতা।যাত্রাদল গুলোর লাইসেন্স বাতিল করা হয়। স্থানীয় ভাবে সার্কাস, পালাগান ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের উপর  নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। স্থানীয় থানাপুলিশ নাশকতা হওয়ার অজুহাতে গ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনে অনুমতি দেয়া বন্ধ করে দেয়। আমাদের দীর্ঘদিনের লালিত সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক চর্চা চরমভাবে ব্যহত হতে থাকে। গ্রামীণ জনজীবনে  চিরচেনা সাংস্কৃতিক চেহারাটি দ্রুত বদলে যেতে থাকে। যাত্রা,সার্কাস,বাউল গান পালাগান, জারিগান, গ্রামীণ মেলা ইত্যাদির জায়গা দখল করে নেয় বিভিন্ন  ধর্মীয় মাহফিল আর বিচিত্র ধরনের পীর ও মাজারের কর্মকাণ্ড।উগ্রবাদ উত্থানের এই  প্রেক্ষাপট রচিত হতে কিন্তু খুব বেশী সময় লাগেনি।পঁচাত্তর পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত এই নিদারুণ বাস্তবতার তৈরি হয়েছে। এরশাদ শাসনের অবসানের পর বি এন পি ক্ষমতায় এসে তাদের পছন্দের পথেই তারা হেঁটেছে। বি এন পি পর ক্ষমতায় আসে মুক্তি যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া দল আওয়ামীলীগ। আওয়ামীলীগের ক্ষমতার ঐ  টার্মে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রকাশ্যভাবে প্রশ্রয় দিতে দেখা যায়নি কিন্তু পরবর্তী টার্মে ক্ষমতায় এসে অদ্যাবধি  এই দলটিকে মৌলবাদীদের কর্ম তৎপরতার কাছে অনেকটা অসহায় বলে প্রতিয়মান হয়েছে।যদিও তারা জঙ্গীবাদী কর্মকান্ড অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তীতে বি এন পি জামাতের হাত ধরে শক্তিশালী হয়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক অপশক্তির  বিস্তার রোধে  আওয়ামীলীগ সরকারের কোন কোন কার্যক্রম দেখা যায়নি বরং প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে  এই বিস্তারকে আওয়ামীলীগ সরকার পৃষ্ঠপোষকতাই করেছে বলা যায়।  আমরা জানি  ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য আওয়ামীলীগও বি এন পির মত ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই তাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছে। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির যে করুন অবস্থা তাতে আওয়ামীলীগ এই পন্থা গ্রহণে অনেকখানিই বাধ্য হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়।সুতরাং বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির  উগ্রবাদের এই অবস্থা  তৈরির জন্য আমাদের অসৎ রাজনীতি বা রাজনৈতিক দৈন্যদশা তথা রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করার হীন প্রবণতা  যে প্রবল ভাবে দায়ী সে কথা বলাই বাহুল্য। এখন প্রশ্ন হলো  সাম্প্রদায়িক উগ্রবাদ বিস্তারের এই বাস্তবতায়  বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের ভূমিকা, কার্যক্রম ও সফলতা এতটা হতশাজনক কেন? সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে আমাদের বুদ্ধিগণ ব্যর্থ হলেন কেন?  ঘাদানিকের পর বুদ্ধিজীবীগণ  এতটা নিস্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা আজ খুবই জরুরি। দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক শক্তির বিস্তার প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য  বি এন পি জামাতের জোট সরকারকে না পারলেও আওয়ামীলীগ সরকারের উপর বুদ্ধিজীবী গণ কেন সম্মিলিত  একটি চাপ প্রয়োগ করলেন না? উগ্রবাদের বিরুদ্ধে দুর্বার সাংস্কৃতিক আন্দোলন সৃষ্টি করার মত অনেক ইস্যুইতো বুদ্ধিজীবীদের সামনে সৃষ্টি হয়েছে। ড: হুমায়ুন আজাদের উপর উগ্রবাদীদের হামলাকে  সরাসরি

বুদ্ধিজীবীদের উপর আক্রমণ বলে গণ্য করা যায়।এই ধরনের নির্মম কর্মকাণ্ডের পরও কেন আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ দায়সারা নিন্দা জানিয়ে  তাদের দায়িত্ব শেষ করলেন?  কেন লাগাতার একটি আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদ তারা অনুভব করলেন না। তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে যখন উগ্রবাদীরা ভয়ানক শক্তি নিয়ে আস্ফালন করলো বুদ্ধিজীবিরা তখন দায়সারা গোছের কিছু বিবৃতি দিয়ে রনে ভঙ্গ দিলেন?  কেন তারা  উগ্রবাদীদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নামেন নি? কেন তারা উপলব্ধি করতে চাইলেন না যে, ভিন্নমতের উপর উগ্রবাদীদের আক্রমণ  এইদেশের শিল্প সাহিত্য তথা সংস্কৃতির উপর বড় এক হুমকি ? একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে আমরা দেখেছি প্রজন্ম একাত্তর নামে তরুণ সমাজ শাহবাগের মোড়ে এক যুগান্তকারী আন্দোলন করতে সমর্থ হয়েছে।সেই আন্দোলনের আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরও নীরব সমর্থন ছিল। এই বিষয়টি দেখার পর বুদ্ধিজীবী সমাজ কেন কেন  দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক অপশক্তির উত্থান ও উগ্রতার বিরুদ্ধে অনুরূপ কোন সাংগঠনিক আন্দোলন গড়ে তুলেন নি? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যেমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তেমনি মৌলবাদের উত্থানের মধ্য দিয়ে  বাঙালি জাতীর সংস্কৃতি ধবংসের ষড়যন্ত্রও কি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়? সরকার যখন মৌলবাদীদের খুশী করার জন্য ধর্মানুভুতিতে আঘাত নামে মুক্তচিন্তার পথ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সংবিধানের বাক স্বাধীনতার সাথে সাংঘর্ষিক একটি কালো আইন প্রণয়ন করলো তখন বুদ্ধিজীবী গণ কেন এর প্রতিবাদ করলেন না? 

এই আইন বাতিলের জন্য কেন তাদের কোন কার্যক্রম জাতি দেখতে পেলোনা? আমাদের বুদ্ধিজীবীগণ কি সরকারের মত উগ্রবাদের ভয়ে ভীত নাকি তারা এসব নিয়ে কাজ করে সরকারের অপ্রিয় হতে চান না?  নাকি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কাজ না করে নিজেদের একটা নির্ভেজাল অবস্থানে রাখতে চাইছেন তারা ?  তারা কি সরকারের কাছে অপাঙতেয়? তারা কি  চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছেন? সেদিন নাট্যজন মামুনুর রশীদকে বলতে শুনলাম যে "এই সরকার মৌলবাদকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। আমরা জানি এই বক্তব্য মামুনুর রশীদ সাহেবের একার নয়। তার কথায় আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজের বা সুশীল সমাজের সাধারণ মতামতেরই প্রতিফলন ঘটেছে। তাহলে কি ব্যাপারটা এমন যে, বুক ভরা হতাশা নিয়ে  নিজের অক্ষমতার বেদনায় আমাদের দায়িত্বশীল  মহান ব্যাক্তিগণ আজ তাদের চোখকে বলছেন দেখ,কানকে বলছেন শোন। তারা আজ অসহায় দর্শক ছাড়া আর বিশেষ কোন ভূমিকায় যেতে পারছেন না।  এই প্রশ্নগুলোর উত্তরে কি বলবেন বুদ্ধিজীবী গণ তা আমরা জানিনা। আমরা শুধু জানি, এই দিন থাকবেনা - নতুন দিন আসবে। সেই নতুন দিনের মানুষের কাছে আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ আজকের দিনের দায় এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ইতিহাস আমাদের সামনে প্রশ্নবোধক আঙুল তুলে দাঁড়াবেই।

No comments:

Post a Comment

আলোর ঝিলিক - শাহজাহান কবীর

 আলোর ঝিলিক  শাহজাহান কবীর  এই যে শনিবার  তারপর আর কি- শুধুই রবিবার সোম,মঙ্গল, বুধ--  বৃহস্পতি -শুক্র --- এইতো তুমি, এইতো আমি  দুলছি নিরর্থক...