Monday, March 27, 2023

বাঙালি কতটুকু ধার্মিক ?


শাহজাহান কবীর। 

বাংলাদেশের গত দুই / তিন দশকের  বাস্তবতা যদি আমরা একটু মোটাদাগে মূল্যায়ন করি তাহলে বলা যায় যে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিস্তার,ধর্মীয় সন্ত্রাস বা রিলিজিয়াস  রেসিজম এখন প্রবল ভাবে শক্তিশালী। শুধু লেবাসধারী কিছু মোল্লা নয়, স্কুল কলেজ পাশ করা,ইউনিভার্সিটি থেকে উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের আচরণ ও মনোভাব এখন কাঠমোল্লাদের মতই। এক কথায় বলা যায় বাংলাদেশের সাধারণ জনতার অধিকাংশই এখন পরমত অসহিষ্ণু ধর্মান্ধ ।তবে এই বাস্তবতার গভীরে যদি আমরা তাকাই এবং সূক্ষভাবে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি সেই সঙ্গে আবহকালের বাঙালী জাতীর সাংস্কৃতিক জীবনের সাথে মিলিয়ে মূল্যায়ন করি তাহলে আমরা যে সত্যটি দেখতে পাব সেটি হচ্ছে বাঙালী আসলে ধর্ম প্রবণ জাতি  নয়, নিচক পূজা অর্চনা বা ইবাদত প্রবণ জাতী নয়। বাঙালীর আন্তরিক চরিত্রে রয়েছে উৎসব প্রবণতা,আনন্দ প্রবণতা । একটু ভালভাবে লক্ষ্য করলেই আমরা দেখবো বাঙালী তাদের ধর্মের আনুষ্ঠানিক বিষয়গুলোর সাথে উৎসবের একটা আবহ সৃষ্টি করতেই পছন্দ করে। শুধুমাত্র  ঈশ্বর, দেবতা,ভগবান বা আল্লাকে সন্তুষ্ট করার জন্য আনন্দবিহীন কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বাঙালী করতে চায়না।সেজন্যই আমরা হিন্দুদের পূজাপার্বণে বাদ্য-বাজনা, নৃত্যগীত ইত্যাদি সহ উৎযাপন করতে দেখি। মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুলোতে যতই ভাব গাম্ভীর্যের কথা বলা হউক না বাস্তবতা হলো ভাবগাম্ভীর্যের বদলে তারা উৎসবের আমেজই তৈরী করতেই আগ্রহী। পীর ফকিদের মাজারে আধ্যাত্মিকতা সাধন করার চেয়ে নেচে গেয়ে পীরের গুণকীর্তন করতেই ভক্তরা বেশী পছন্দ করে।   রমজানের রোজাকে বলা হয় আত্মশুদ্ধি বা সকল বিষয়ে সংযম পালন করার মাস অথচ বাস্তবে আমরা দেখি ঈদতো বটেই, ইফতার, সেহেরি, তারাবী  নামাজ প্রতিটি বিষয়ে অতিরঞ্জিত আয়োজনের মাধ্যমে  একটা অনন্দ,ফূর্তি  বা উৎসবের আবহ সৃষ্টি করা হয়। কে কতটুকু আত্মসংযম করলো সেইদিকে মোটেই ভ্রুক্ষেপ না করে কে কোন পোশাকটি ক্রয় করবে কে ভাবে কত ভাল করে ইফতারের আয়োজন করবে, সেহেরিতে ভূরিভোজনের জন্য আরও কি আয়োজন করা যাবে,রোজার মাসকে  কিভাবে আরও আনন্দময় করা যাবে সেই চিন্তা আর আয়োজনেই রমজান মাস কাটে বাঙালী মুসলমানে।শবে বরাতের রাতে ভাগ্য উন্নয়নের জন্য ইবাদত করার চেয়ে বাঙালী মুসলমান বেশী মনোযোগ দেয় রুটি হালুয়া আর মুখরোচক খাবার তৈরীতে। তরুণ সমাজ তো শবে বরাতে পটকা ফোটানো আর আতসবাজীতেই ব্যস্ত সময়  কাটায়,পুলিশ ভয়ভীতি প্রদর্শন করেও শবেবরাতের পটকা ফোটানো বন্ধ করতে পারেনা। ভবিষ্যতেও পারবেনা কারণ যে পথে আনন্দ নেই বাঙালী  সেই পথে যেতে চায়না। এটাই মূলত বাঙালী চরিত্রের বৈশিষ্ট্য । বাঙালী আসলে ধর্মের প্রতি আন্তরিক ভাবে আকৃষ্ট কোনদিনই ছিল না,এখনো নয়।  ধর্মান্ধতা, ধর্মভীরুতা,সাম্প্রদায়িক উগ্রতা এগুলো বাঙালির উপর ধর্ম ব্যবসায়ী, ধর্মীয় রাজনীতি আর অপরাষ্ট্র ব্যবস্থা কতৃক আরোপিত একটা উপরি বা প্রচলিত কথ্য ভাষায় বলতে গেলে আলগা চরিত্র ।আমাদের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে, যথাযথ শিক্ষার অভাবে সহজ সরল বাঙালি উচ্চতর মানসিক অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনা বিধায় ধর্মে উল্লেখিত অলৌকিক শাস্তিকে তারা ভয় পায়, ধর্মে উল্লেখিত লোভনীয় অফার গুলোর প্রতি তাদের লোভও হয়। ধর্ম ব্যবসায়ীদের তৈরি নিত্যদিনের  ধর্মীয় সামাজিক চাপের কারণে বাঙালি ধর্মভীরু হতে সাম্প্রদায়িক হতে, উগ্রবাদী হতে নিজের অজান্তেই আসলে বাধ্য হয়,বাধ্য হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্ব থেকে ঔপনিবেশিক  শাসনের সময়ই বাঙালির উপর একটি ধর্মীয় উগ্রবাদী চরিত্র আরোপিত করার চেষ্টা হয়েছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়  সেই অপশক্তির নগ্ন উল্লাস দেখেছে বিশ্ববাসী । মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়েও তারা ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার  মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক  অন্ধকারের রাজত্ব পূণরায় কায়েম করতে সক্ষম হয়। ১৯৭২ এর প্রণীত সংবিধানের মূল চারটি নীতির একটি  ছিল সাম্প্রতিক সম্প্রতি বা অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র ব্যবস্থা । ১৯৭৭ এ পঞ্চম সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান  সেই নীতিকে ধবংস করেন।আবারও দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে বাঙালীকে ধর্মান্ধ বানাতে উঠেপড়ে লাগে ধর্ম ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশকে পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান বানানোর মিশন চালিয়ে যেতে থাকে অবলিলায়। আরেক সেনাশাসক জেনারেল এরশাদ  রাষ্ট্র ধর্মের মত ব্যাপার ঘটিয়ে  সেই মিশনের সফলতাকে আরো অনেক ধাপ এগিয়ে দেয়। এভাবে পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশের সুযোগ সন্ধানী ক্ষমতালিপ্সু  শাসকদের প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে  সৃষ্ট  হয় ধর্মান্ধতা প্রচার ও প্রসারের অনুকূল অবস্থা। এই অবস্থা এমনই শক্তিমত্তা অর্জন করে যে, ধর্ম ব্যবসায়ীরা অনগ্রসর  জনগোষ্ঠীর চিন্তায় হিপনোটিজমের মত একটা শক্ত  ধর্মীয় চাপ ও প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। এবং এই চাপে সবচেয়ে  বেশী প্রভাবান্বিত হয় তরুণ সমাজ। এই তরুণ সমাজই পরবর্তীতে সমাজের সর্বস্তরে ধর্মান্ধতাকে ছড়িয়ে দিতে থাকে। প্রৌঢ় সমাজ তরুণদের ধর্মের বিষয়ে এতটা আগ্রহী দেখে বিষয়টাকে সুনজরে দেখতে থাকে এবং নিজেদের অন্তরের প্রকৃত অবস্থাকে অস্বীকার  না করেও তারা অধিকতর ধার্মিক হওয়ার একটা উপরি চেষ্টা করার তাগিদ অনুভব করতে থাকে।  এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সহজেই সিদ্ধান্ত নেয়া যায় যায় বর্তমানে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় উগ্রতা আমরা লক্ষ্য করছি সেটি বাঙালির প্রকৃত চরিত্র নয় মোটেও বরং দীর্ঘদিনের দেশী বেদেশী মৌলবাদী অপশক্তির বিরামহীন ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এদেশের অজ্ঞ জনতার উপর আরোপ করা একটা  ক্ষণস্থায়ী অবস্থা বিশেষ মাত্র। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে রেষারেষি, হিংসা, বিদ্বেষ,  অশান্তি সৃষ্টি করার মত মানসিকতা সাধারণ জনতা কখনোই লালন করতে ইচ্ছুক নয়।  তাই বাঙালির অতি ধার্মিক হওয়ার বিষয়টি তাদের স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক আচরণ  নয়। তাদের চারদিকে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে যে অতি ধার্মিক হওয়ার একটা প্রতিযোগিতা শুরু  হয়েছে।প্রতিটি ব্যক্তিই সে যত নষ্ট  মানুষই হউক ধর্মের স্বপক্ষে দুটি কথা বলে নিজের গায়ে একটা ধর্ম প্রেমের তকমা লাগাতে চায়। এই ধার্মিক সাজার কর্মটি যে একটা আত্ম প্রবঞ্চনা এটি কিন্তু সবাই জানে তবুও সামাজিক অবস্থান ঠিক রাখার জন্য এই প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেনা। সমাজের আরেকটা শ্রেণী আছে যারা নানা রকম দুস্কর্ম করে  অর্থনৈতিক ভাবে, রাজনৈতিক ভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে প্রতিনিয়ত নানান অপকর্ম করে যাচ্ছে, এরা নিজেদের অপকর্মকে ঢেকে রাখার জন্য ধর্ম পালনের প্রতি অতি উৎসাহী হয়।এই প্রভাবশালী শ্রেণীটির কারণে সাধারণ জনতা ধর্মীয় বিষয়ে আরও একটু বেশী বিভ্রান্ত হয়।  এই অবস্থার মধ্যে বসবাস করতে করতে কখনো তারা এটিকেই সত্য বা উচিত  অবস্থা বলেও ভাবতে থাকে। এই ভয়াবহ অবস্থার মাঝেও বাঙালি তার চিন্তা- চেতনার আসল রূপ ভুলে যায়নি। সে কারণেই ধর্মীয় প্রতিটি বিষয়কে তারা অবশেষে উৎসবেই পরিনত করে। ঈশ্বরকে নয়,ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে মুলত তারা নিজেকেই খুশী রাখতে চায়,ধর্ম পালনে ঈশ্বরের সন্তুষ্টি নয় -আত্ম সন্তুষ্টিই খুঁজে। বাঙালি  পূজা বা ইবাদতে প্রকৃত নয়,শুদ্ধ নয়,সত্য নয়। ধর্ম পালনে বাঙালি মূলত আত্ম প্রবঞ্চক ও ভন্ড। বাঙালির শুদ্ধ ও সত্যনিষ্ঠ পরিচয় ফুটে উঠে উৎসবে - আনন্দে। বাঙালির উপর যতই ধর্মীয় আবেগ চাপানো হউক,একটি  সুরেলা গান শুনলেই বাঙালি সবকিছু ভুলে গানটিই উপভোগ করবে। শহরের বাঙালি ব্যন্ডদলের কনসার্ট শুনলেই নেচে উঠবে, জারি, সারি,ভাটিয়ালি, বাউল গান আর যাত্রার কনসার্ট শোনামাত্রই গ্রামের বাঙালির শরীর দুলে উঠবেই। হাজারো ধর্মীয় বোঝা মাথার উপর চাপিয়ে দিলেও উৎসব প্রবণ বাঙালিকে উৎসবের আকর্ষণ থেকে ফেরানো  যাবেনা। এখানেই মূলত প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের পরাজয় আর আমাদের জন্য নতুন  প্রত্যাশার জায়গা। যদি আমাদের শিক্ষা  ব্যবস্থাকে আধুনিক ও সময় উপযোগী করা হয়। শিক্ষা গ্রহণের প্রতিটি ধাপে যদি কর্মমূখী বিষয়ের মত,সাহিত্য,  সংগীত,চারুকলা, নাট্যকলার মত বিষয়গুলোকে বেশি করে গুরুত্ব দেয়া হয় আর শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতার লোভে ধর্মান্ধতার প্রশ্রয় না দেয় তাহলে অবশ্যই একদিন বাঙালির অতি ধার্মিক সাজার এই ক্ষণস্থায়ী মুখোশটি খসে পড়বে, বাঙালি এগিয়ে যাবে তার প্রকৃত পরিচয় নিয়ে । 




No comments:

Post a Comment

আলোর ঝিলিক - শাহজাহান কবীর

 আলোর ঝিলিক  শাহজাহান কবীর  এই যে শনিবার  তারপর আর কি- শুধুই রবিবার সোম,মঙ্গল, বুধ--  বৃহস্পতি -শুক্র --- এইতো তুমি, এইতো আমি  দুলছি নিরর্থক...