Friday, April 21, 2023

সোবান আলীর চান রাইত -শাহজাহান কবীর। ( ছোটগল্প)



 প্রচন্ড ভীড়ে, দু:সহ গরমে ঘেমে - নেয়ে সোবান আলীর পরিবার যখন ঈদের কেনাকাটা কোন রকমে শেষ করে বাড়ীতে ফেরার সিদ্ধান্ত নিল ততক্ষণে ঈদ বাজারের ভীড়ের অবস্থা এমন হলো যে যতদুর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত পুরো এলাকাটি যেন ঠাসাঠাসি করে দাঁড়ানো বিপুল জনতার বিস্তৃত ভীড়ে এক বিশাল জনসমুদ্রে  পরিনত হয়েছে। 
বৈশাখের সূর্য তখন অনেকখানি পশ্চিমমুখী হলেও রোজাদারদের প্রতি কোনরকম দয়ামায়া না দেখিয়ে  যেন আরও উগ্রতা নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা জমাটবদ্ধ জনতার উপর আগুন ছড়াতে লাগল।গরমে, ঘামে, ভীড়ের চাপে  প্রতিটি মানুষের চোখ মুখের অবস্থা এমন করুন দেখাচ্ছে যে মনে হচ্ছে অসংখ্য মানুষ কোন সংকীর্ণ ফাঁদে আটকা পড়ে এই মহাবিপদ থেকে  উদ্ধার পাওয়ার জন্য  প্রাণপণে কোন উপায় খুঁজছে।সোবান আলী মহাবিরক্ত চোখে বেরোবার পথের দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় বলে- 'অইছে কাম, এই ভীড়ের মধ্যে বাইর অইবো ক্যামনে?  বিরাট বিপদে পড়লাম দেহি।" সোবহান আলীকে ঘিরে তার ছোট ছোট চার ছেলে মেয়ে। তিন মেয়ে এক ছেলে। ছেলেটা সবার ছোট - ছয় বছরের শিশু। পেছনে তার স্ত্রী জরিনা। তার এক হাতে একটা ব্যাগ আর অন্যহাত ব্যস্ত শাড়ি সামলানোর জন্য। ভীড়ের চাপে বার বার শাড়ির আঁচল পড়ে যাচ্ছে। কিছুতেই সামলাতে পারছেনা। বাকী জিনিস পত্র সব একটি বড় ব্যাগে।সেই ব্যাগ সোবান আলীর কাঁধে। এক হাতে ব্যাগ ধরা অন্য হাতে ভীড়ের মধ্যে পুত্র কন্যাদের সামাল দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় অস্থির সোবান আলী পেছনে থাকা স্ত্রীর উদ্দেশ্য যথেষ্ট বিরক্তি নিয়ে উঁচু গলায় বলে- " একশ বার কইলাম, চানরাইতের বাজার,ভীড়ের মধ্যে পোলাপান বাজারে আননের দরকার নাই।শুনলো না আমার কথা।হে চৌদ্দ গোষ্ঠী লইয়া ঈদের বাজার করবো। অহন ঠেলাডাতো বুঝতাছি আমি,তার কি  "
সোবহান আলীর এই কথা জরিনা শুনতে পেলে সোবান আলীকেও জরিনার বাজখাঁই গলার দশ কথা  শুনতে হতো। কিন্তু ভীড়ের ধাক্কায় সোবান আলী ততক্ষণে  পুত্রকন্যা সহ জরিনা থেকে  অনেক খানি দূরে সড়ে গেছে। এদিকে পাশের এক জুতার দোকানের দুই সেলসম্যান দ্বৈত কন্ঠে সুর করে বলছে  " মা বইনেরা শুইনা যান, লুইচ্ছা হইতে সাবধান।  আপনার আশেপাশে, লুচ্ছারা ঘুরতে আছে। স্বামী সন্তানদের খুঁজে ব্যস্ত জরিনা যখন  দুই সেলসম্যানের সুরের দিকে খানিকটা মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছিল তখনই তার নিতম্বে একটা হাতের চাপ অনুভব করলো। সঙ্গে সঙ্গে পানির নীচে হাতড়িয়ে মাছ ধরার মত ভীড়ের মধ্যে হাতড়িয়ে জরিনা সেই হাতটি খপ করে ধরে ফেললো । তারপর অগ্নিমূর্তি ধারণ করে হাতের মালিকের দিকে তাকিয়ে দেখলো   কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা এক প্রবীণ জরিনার থাবা থেকে তার বেয়াড়া হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।জরিনা  পৌঢ়ের মুখের দিকে তাকি চিৎকার করে বলে উঠে " হারামজাদা বদমাইস, হাটেবাজারে আইসা লুচ্চামি করস!  আইজ তরে ছাড়ুম না।জুতা দিয়া বাইরায়া এক্কেবারে লম্বা কইরা ফালামু। জরিনা জুতা হাতে নেয়ার জন্য তার ডান পা- খানা উঁচু করার চেষ্টা করতেই জুতাটি তার হাতে না উঠে ভীড়ের ধাক্কায়  পলকের মধ্যে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। এই সুযোগে কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা প্রবীণ  তার বেয়াড়া হাত উদ্ধার করে মুহূর্তের মধ্যে জনারণ্যে হারিয়ে গেল। জরিনা তার হারিয়ে যাওয়া জুতার সন্ধানের চেষ্টা না করে বরং তার নিতম্বে চাপ প্রয়োগকারীর প্রতি বিরতিহীন গালাগাল করতে করতে স্বামী সন্তানের সন্ধান করতে লাগলো। এদিকে সোবান আলী কিছুদূর পর্যন্ত  তার পুত্র কন্যার দলকে সামলে নিয়ে চলার পর হঠাৎ একটা ধাক্কায় সে পুত্রকন্যা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।  চার শিশু পিতা থেকে বিচ্ছিন্ন  হয়ে পরস্পরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ভীড়ের ধাক্কায় এদিক সেদিক যেতে যেতে চিৎকার করে আব্বা আব্বাগো বলে কাঁদতে  লাগলো। মানুষের কথার আওয়াজে  খুব কাছেই থাকা পুত্রকন্যার কান্নার শব্দ সোবান আলী শুনতে পাচ্ছেনা। সোবান আলী নিজেও  সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে পুত্র কন্যাদের ডাকতে লাগলো। অনেক ক্ষণ ডাকাডাকি আর কান্নাকাটির পর সোবান আলী তার কান্নারত পুত্র কন্যাদের আবিষ্কার করতে পারে।শিশুরা তার পিতাকে পেয়ে চারদিকে চারজন জড়িয়ে ধরে  আব্বাগো বলে আরও দ্বিগুণ শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। সোবান আলী জোরে ধমক দেয়- " চুপ থাক!  মরা কান্দন শুরু করছস কি জন্য?  মার কথায় লাফাইতে লাইফাইতে আইছস কি জন্য ঈদের বাজার- অ, ফাজিলের দল। পিতার ধমকে  শিশুরা কান্না বন্ধ করলেও পিতাকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পুত্রকন্যার বেড়ি,  কাঁধের ব্যাগের ওজন, ঠাসা ভীড়ের চাপ আর গরমে অতিষ্ঠ সোবান আলীর মনে হচ্ছিল সে চোরাবালি তে তলিয়ে যাচ্ছে। তার এই নাজেহাল অবস্থার  জন্য স্ত্রী জরিনাকে দায়ী করে প্রচন্ড ক্ষুব্ধ সোবান আলী দাঁতে দাঁত চেপে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে অশ্লীল শব্দ উদগীরণ করতে থাকে - " হারামজাদি মাগী! আমার একটা কথা হুনেনা - পোলাপান গুলারে না আনলে এই অবস্থা অইতো!  বেত্তমিজ মাগী!  জরিনার উপর এমনিতেই আজ সোবান আলীর অনেক  রাগ। এইবার ঈদের বাজার করার কোন ইচ্ছা ছিলনা তার। গরীবের আবার কিয়ের ঈদ।  হাত একেবারে খালি। একমাত্র সম্বল ব্যাটারির অটোগাড়ীটা দুই মাস আগে চুরি হয়েছে। সোবান আলী এই দুইমাস নানান জায়গায় ঘুরেছে কাজের সন্ধানে। পরিশ্রমের কাজ তার দ্বারা হয়না। তার পেটে মারাত্মক শুল ব্যাদনা। পরিশ্রমের কাজ করতে গেলেই ব্যাদনা ওঠে। ডাক্তার  বলেছে অপারেশন ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু বিনা পরিশ্রমের কাজ সে পাবে কোথায়।  এই অবস্থায় জরিনাকে যখন বললো " এইবার ঈদমিদ বাদ রাখ।পোলাপানরে বুঝাও। টাকা পয়সা নাই। " কথাটা বলা মাত্রই চিৎকার চেচামেচি করে বাড়িঘর মাথায় তুললো জরিনা। মুখে যা আসে তাই বলতে লাগলো সোবান আলীকে।" নিমুরাদ্দেয়া এক বেডার ঘরে বাপে বিয়া দিছে। বাপে বিয়া দেওনের আর মানুষ পাইলোনা, আমার জীবনডা ছারখার কইরা দিল এই বেডায়। বছরের পরথম ঈদ হে কয় ঈদের বাজার করতে  পারতো না।তার কাছে টেকা নাই।দুনিয়ার সব মাইনসের কাছে টেকা থাকে তার কাছে থাকে না। কি কপাল আমার। জরিনার সর্ব শেষ কথা ছিল এই- পোলাপানের জন্য ঈদের কাপড় চোপড় না কিনলে পোলাপান লইয়া লইয়া আমি দেশান্তরি অইমু 
।অবশেষে অনেকদিন ধরে জমানো বিশ হাজার টাকা নিয়ে ঈদের বাজার করতে আসলো।টাকাটা সে জমাচ্ছিল তার পেটের অপারেশন করানোর জন্য। ত্রিশ হাজার টাকা হলেই অপারেশনটা করানো যেতো।ডাক্তার তাই বলেছিল।কিন্তু গাড়িটা চুরি হওয়ায় বিশ হাজারের মধ্যেই আটকে গেল তার টাকা জমানো।তবু সোবান আলী এই টাকাটায় হাত দিতে চাইছিলনা। যেভাবেই হউক বাকি টাকাটা যোগার করে অপারেশনটা করাবেই। পেটের এই যন্ত্রণা আর সহ্য করা যায়না। মাঝে মাঝে অবস্থা এমন হয় যে ব্যথার কারণে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে সোবান আলীর। বাজারের টাকা কিভাবে যোগাড় হলো একবারও জানতে চায়নি জরিনা। ছেলেমেয়েদের জন্য কেনাকাটা করতে পারবে এই আনন্দেই সে আত্মহারা। জরিনার জন্য একটা শাড়ি আর সোবান আলীর জন্য একটা পাঞ্জাবিও কেনা হয়েছে। তবে আড়াইশ টাকার পাঞ্জাবি কিনতে গিয়ে ভীড়ের চাপে তার গায়ে থাকা তিনশো টাকা দামের জামাটা ছিড়ে গেল সোবান আলীর।সব মিলিয়ে সোবান আলীর মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে থাকলেও অবশেষে সন্ধার সামান্য আগে বাড়িতে পৌঁছে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় কাল বৈশাখী ঝড়। ঝড় বৃষ্টির কারণে ঈদের চাঁদ দেখা না গেলেও আগামীকাল ঈদ নিশ্চিত জানা গেল। বড় মেয়ের জামা অন্যদের চেয়ে খারাপ হয়েছে সে কান্নাকাটি করছে।ছোট ছেলের জুতা পায়ে ঠিক মত লাগেনা সে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলছে।  গরুর মাংস আটশ টাকা কেজি, তাই গরুর মাংস কেনা হয়নি।এই নিয়ে গাল ফুলিয়ে রেখেছে বড় ছেলেটা। পোলাপানের অসন্তোষ অবস্থা দেখে জরিনা আরও বেশি অসন্তুষ্ট। সেও কিছুক্ষণ বিলাপ করে কাঁদলো নিজের দুর্ভাগ্যের জন্য।বিদ্যুৎ নেই।অন্ধকারে বারান্দায় একা বসে আছে সোবান আলী। হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় তার ছোট বেলার একটি চাঁদ রাতের কথা। সোবান আলী তার ভাইবোনের সাথে মাকে নিয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য। আগামীকাল ঈদ,বাবার কাছে টাকা নেই,তবু বাবা বাজারে গেছে।এদিকে সব ভাইবোন অপেক্ষা করছে তার বাবা নিশ্চয়ই হাটবাজার নিয়ে ফিরবে।সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয় সোবান আলীর বাবা আর ফেরে না। রাত নয়টার দিকে বিধবস্ত শরীরে বাড়িতে ফেরে বাবা। ঘরে ঢুকেই অপেক্ষা রত ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সোবান আলীর বাবা। মা জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে তার। সোবান আলীর বাবা বলেন - একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা হাউলাৎ করে ঈদের কিছু  কেনাকাটা করেছিলেন তিনি।মাগরিবের নামাজের ওয়াক্তে সদায়পাতি রাখা ব্যাগটা এক পরিচিত দোকানে রেখে নামাজ পড়তে যান সোবান আলীর বাবা।ফিরে এসে দেখেন  তার ব্যাগটি চুরি হয়ে গেছে। সোবান আলী ভাবে এই ঘটনা প্রায় চল্লিশ বছর আগের। চল্লিশটা বছর কেটে গেল সোবান আলীদের অভাব গেলনা। এই জীবনে কোন ঈদ, কোন চাঁদ রাত অভাব বিহীন কেটেছে কিনা সোবান আলী মনে করার চেষ্টা করে। কিন্তু মনে করতে পারেনা। হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠে সোবান আলী।  শব্দ শুনে এগিয়ে আসে জরিনা। প্রশ্ন করে -কান্দ নাকি তুমি? সোবান আলী  অন্ধকারে অশ্রু আড়াল করে বলে - আরে না কান্দনের কি অইছে?  কান্দুম কি জন্য। জরিনা চলে যাওয়ার পর  আবারও  নি:শব্দে কাঁদে সোবান আলী। মনে মনে বলে সোবান আলীদের চান রাইত কোন দিনই সুখের অয়না।


No comments:

Post a Comment

আলোর ঝিলিক - শাহজাহান কবীর

 আলোর ঝিলিক  শাহজাহান কবীর  এই যে শনিবার  তারপর আর কি- শুধুই রবিবার সোম,মঙ্গল, বুধ--  বৃহস্পতি -শুক্র --- এইতো তুমি, এইতো আমি  দুলছি নিরর্থক...